তেহারি রেসিপি – পুরান ঢাকাইয়া আসল স্বাদ

Tehari recipe

পুরান ঢাকার আসল বিফ/মাটন তেহারি রেসিপি – ঢাকাইয়া ঐতিহ্যের স্বাদ

ভূমিকা

তেহারি হলো ঢাকাইয়া ঐতিহ্যের স্বাদ। পুরান ঢাকার খাবারের নাম শুনলেই যে পদটি সবার আগে মনে পড়ে, তা হলো তেহারি। এর দারুণ সুগন্ধ, ঝাল-মশলার ঝাঁঝালো স্বাদ আর নরম মাংসের সাথে ভাতের অপূর্ব মেলবন্ধন প্রতিটি ভোজনরসিককে মুগ্ধ করে।

সাধারণ পোলাও বা বিরিয়ানির থেকে তেহারির স্বাদ ও পরিবেশনের ধরণ ভিন্ন। বিরিয়ানি যেখানে ভারী ও ঘি-সমৃদ্ধ, তেহারি সেখানে তুলনামূলক হালকা হলেও স্বাদ ও ঘ্রাণে অনন্য।

পুরান ঢাকায় তেহারি শুধু একটি খাবার নয়, এটি একধরনের সংস্কৃতি। ঈদ, বিয়ে, দাওয়াত বা শুক্রবারের পারিবারিক লাঞ্চ—সব জায়গাতেই তেহারির আলাদা কদর রয়েছে।


তেহারির ইতিহাস ও উৎপত্তি

তেহারির উৎপত্তি মুঘল আমলে। পারস্য ও দিল্লির দরবারি রাঁধুনিদের হাত ধরে এটি বাংলায় আসে। “তেহারি” শব্দটি এসেছে তাহারি শব্দ থেকে, যার অর্থ ভাত ও মাংস একসাথে রান্না করা।

পুরান ঢাকায় তেহারি জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ হলো এর সহজ রান্না পদ্ধতি এবং তুলনামূলক কম ঘি ব্যবহার। তবে স্বাদে কোনো কমতি নেই। সরিষার তেল, দেশি মশলা আর উৎকৃষ্ট মানের গরু বা খাসির মাংস দিয়ে তৈরি ঢাকাইয়া তেহারি আজও সবার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।


কেন পুরান ঢাকার তেহারি রান্না করবেন?

  1. অথেন্টিক স্বাদ – সরিষার তেল আর দেশি মশলার ঝাঁজ তেহারিকে অনন্য করে তোলে।
  2. হালকা অথচ মজাদার – বিরিয়ানির মতো ভারী নয়, তবে স্বাদে গভীর।
  3. ঐতিহ্যের ছোঁয়া – পুরান ঢাকার সাংস্কৃতিক খাবারের অংশ।
  4. দাওয়াত ও উৎসবের জন্য উপযুক্ত – অতিথি আপ্যায়নে অপরাজেয়।
  5. অন্যরকম রান্না পদ্ধতি – মাংস আগে মশলা দিয়ে কষানো হয়, তারপর ভাত দেওয়া হয়।

 পুরান ঢাকার আসল তেহারি রেসিপি

উপকরণ (৬–৮ জনের জন্য):

মাংসের জন্য:

  • গরু বা খাসির মাংস (হাড় চরবিসহ ছোট ছোট করে কাটা ) – ১.৫ কেজি
  • সরিষার তেল – ১ কাপ
  • পেঁয়াজ – ৫০০ গ্রাম (পাতলা করে কাটা)
  • রসুন বাটা – ২ টেবিল চামচ
  • আদা বাটা – ২ টেবিল চামচ
  • কাঁচা মরিচ বাটা – ১ টেবিল চামচ
  • দই – ½ কাপ
  • লবণ – পরিমাণমতো
  • লাল মরিচ গুঁড়া – ২ চা চামচ
  • ধনে গুঁড়া – ২ চা চামচ
  • জিরা গুঁড়া – ১ চা চামচ
  • গরম মসলা গুঁড়া – ১ চা চামচ
  • তেজপাতা – ৩টি
  • দারুচিনি – ২–৩ টুকরা
  • এলাচ – ৪–৫টি
  • লবঙ্গ – ৪–৫টি
  • গোলমরিচ – ৮–১০টি

ভাতের জন্য:

  • কালিজিরা/বাসমতি চাল – ১.৫ কেজি (ধুয়ে আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা)
  • কাঁচা মরিচ – ৬–৮টি (আস্ত)
  • লবণ – স্বাদমতো
  • গরম পানি – প্রায় ২.৫ লিটার (চালের ধরন অনুযায়ী কম-বেশি হতে পারে)

গার্নিশ ও ঘ্রাণের জন্য:

  • বেরেস্তা (ভাজা পেঁয়াজ) – ১ কাপ
  • কেওড়া জল – ১ টেবিল চামচ
  • ঘি – ২ টেবিল চামচ (ঐচ্ছিক)

রান্নার ধাপ

ধাপ ১ – মাংস কষানো

  1. বড় হাঁড়িতে সরিষার তেল গরম করে ধোঁয়া ওঠা পর্যন্ত জ্বাল দিন, তারপর একটু ঠান্ডা করুন।
  2. পেঁয়াজ ভেজে সোনালি বাদামী হলে অর্ধেক বের করে রাখুন।
  3. এখন রসুন, আদা ও কাঁচা মরিচ বাটা দিয়ে কষিয়ে নিন।
  4. লাল মরিচ, ধনে ও জিরা গুঁড়া দিয়ে ভালোভাবে নাড়তে থাকুন যতক্ষণ না তেল ছেড়ে আসে।
  5. মাংস দিয়ে মাঝারি আঁচে নেড়ে কষিয়ে নিন যাতে মশলা মাংসে ভালোভাবে মিশে যায়।
  6. দই, লবণ ও সব গরম মসলা (তেজপাতা, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ) দিয়ে কষাতে থাকুন।
  7. ঢেকে ৩০–৪০ মিনিট রান্না করুন, প্রয়োজনে সামান্য পানি দিন।

ধাপ ২ – চাল যোগ করা

  1. মাংস প্রায় ৯০% সিদ্ধ হলে ভিজানো চাল দিয়ে দিন।
  2. হালকা হাতে মিশিয়ে দিন যেন চাল ভেঙে না যায়।
  3. গরম পানি ও লবণ দিন।
  4. কাঁচা মরিচ দিয়ে দিন।
  5. ঢেকে মাঝারি আঁচে রান্না করুন যতক্ষণ না পানি শুকিয়ে আসে।

ধাপ ৩ – দম (স্টিম) দেওয়া

  1. ভাত প্রায় সিদ্ধ হলে কেওড়া জল ও ভাজা পেঁয়াজ ছিটিয়ে দিন।
  2. ইচ্ছা করলে ২ টেবিল চামচ ঘি দিয়ে দিন।
  3. ঢাকনা ভারি কোনো বস্তু দিয়ে ঢেকে দিন।
  4. একদম হালকা আঁচে ২০ মিনিট দমে রাখুন।
  5. এরপর ঢাকনা খুলে ভাত আস্তে আস্তে নেড়ে আলগা করে দিন।

এভাবেই তৈরি হবে পুরান ঢাকার আসল বিফ/মাটন তেহারি।


পরিবেশনের উপায়

  • গরম গরম তেহারি পরিবেশন করুন শসা-পেঁয়াজ-লেবুর সালাদের সাথে।
  • সাথে থাকুক ঢাকাইয়া বোরহানি—তাহলেই আসল মজা।
  • চাইলে আচার বা ভাজা বেগুন রাখতে পারেন।
  • বিশেষ অনুষ্ঠানে কাবাব বা ফ্রাইড চিকেনের সাথে পরিবেশন করলে জমবে আরও বেশি।

তেহারির ব্যবহার

  • শুক্রবারের পারিবারিক লাঞ্চের জন্য পারফেক্ট।
  • ঈদে অবশ্যই টেবিলে থাকা উচিত।
  • বিয়ে বা দাওয়াতে অতিথি আপ্যায়নে অপরিহার্য।
  • এক পদের খাবার হিসেবেও যথেষ্ট।

সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)

প্রশ্ন ১: তেহারি আর বিরিয়ানির মধ্যে পার্থক্য কী?
👉 তেহারিতে মাংস ও চাল একসাথে রান্না করা হয়, ঘি কম ব্যবহার হয়। বিরিয়ানিতে ভাত আলাদা সেদ্ধ করে স্তর করে দেওয়া হয় এবং ঘি বেশি থাকে।

প্রশ্ন ২: চিকেন দিয়ে তেহারি করা যায় কি?
👉 করা যায়, তবে আসল স্বাদ গরু বা খাসির মাংসেই পাওয়া যায়।

প্রশ্ন ৩: সরিষার তেল কেন ব্যবহার করতে হয়?
👉 সরিষার তেল তেহারিতে অনন্য ঘ্রাণ ও স্বাদ আনে। অন্য তেল ব্যবহার করলে সেই ঢাকাইয়া স্বাদ আসবে না।

প্রশ্ন ৪: চাল যাতে লেগে না যায় তার উপায় কী?
👉 চাল ধুয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে এবং সঠিক পানি-চাল অনুপাত মানতে হবে।

প্রশ্ন ৫: রান্না করা তেহারি কি সংরক্ষণ করা যায়?
👉 হ্যাঁ, তবে ফ্রিজে এয়ারটাইট কন্টেইনারে রাখতে হবে। পরিবেশনের আগে হালকা পানি ছিটিয়ে গরম করতে হবে।


পারফেক্ট তেহারির টিপস

  • হাড়সহ মাংস ব্যবহার করুন—এতে ঝোল ও স্বাদ দুটোই বাড়ে।
  • বেরেস্তা সোনালি করে ভাজুন, বেশি পুড়িয়ে ফেলবেন না।
  • কালিজিরা চাল ব্যবহার করলে ঢাকাইয়া স্বাদ আসবে, তবে বাসমতিও ব্যবহার করা যায়।
  • দম দেওয়ার সময় হালকা আঁচ ব্যবহার করতে হবে।
  • বেশি ঘি দেবেন না—তেহারির আসল স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে।

উপসংহার

পুরান ঢাকার তেহারি শুধু একটি রেসিপি নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। সরিষার তেল, মশলা আর নরম মাংসের সাথে চালের অসাধারণ মেলবন্ধন প্রতিটি কণা ভাতকে করে তোলে স্বাদে ভরপুর। পরিবারের জন্য রান্না করুন কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানে অতিথিদের জন্য—ঢাকাইয়া তেহারির স্বাদ কখনো ভুলবার নয়।

One thought on “তেহারি রেসিপি – পুরান ঢাকাইয়া আসল স্বাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *