কালা ভুনা – চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ঝাল গরুর মাংসের ড্রাই কারি
ভূমিকা:
কালা ভুনা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রেসিপি। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের রান্নায় রয়েছে নিজস্ব স্বাদ ও বৈশিষ্ট্য। চট্টগ্রামের খাবারের কথা উঠলেই যে নামটি সবার আগে মনে পড়ে, তা হলো কালা ভুনা। গাঢ় বাদামি-কালো রঙের এই মাংসের রান্না শুধু স্বাদের জন্য নয়, বরং ঐতিহ্যের জন্যও বিখ্যাত।
ঈদ-উল-আযহা, বিয়ে, ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে কালা ভুনা অপরিহার্য একটি পদ। ধীরে ধীরে কম আঁচে রান্না করার ফলে মাংস হয় নরম, মশলা হয় ঘন, আর প্রতিটি টুকরো মাংসে জমে ওঠে দারুণ স্বাদ।
কালা ভুনার উৎপত্তি
কালা ভুনার জন্ম চট্টগ্রামে। এ অঞ্চলের মানুষ ঝাল, মশলাদার খাবার পছন্দ করেন। মুগলাই প্রভাবিত ঢাকার রান্নার থেকে আলাদা, চট্টগ্রামের রান্নায় রয়েছে গ্রামীণ কৌশল আর ভিন্ন মশলার ব্যবহার।
প্রথমদিকে বড় বড় অনুষ্ঠানে গরুর মাংস বিশাল হাঁড়িতে ধীরে ধীরে রান্না করা হতো, যেখানে প্রচুর পেঁয়াজ, মশলা ও তেল ব্যবহার করা হতো। সেই রান্নাই আজকের কালা ভুনার মূল রূপ। সময়ের সাথে সাথে এটি সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
কেন কালা ভুনা খাবেন?
- আসল চট্টগ্রামের স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন।
- উৎসবের খাবার হিসেবে এটি অনন্য।
- ঝাল ও মশলাদার স্বাদ যারা ভালোবাসেন তাদের জন্য পারফেক্ট রেসিপি।
- স্লো-কুকড রান্না যা মাংসকে নরম ও সুস্বাদু করে।
- বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে মানানসই – ভাত, পোলাও, পরোটা বা খিচুড়ির সাথে দারুণ লাগে।

কালা ভুনা’র পূর্ণ রেসিপি
(৬–৮ জনের জন্য)
মাংস মেরিনেশনের জন্য (গরুর মাংস ১.৫ কেজি):
- দই – ১ কাপ
- আদা বাটা – ২ টেবিল চামচ
- রসুন বাটা – ২ টেবিল চামচ
- পেঁয়াজ বাটা – ২টি বড়
- হলুদ গুঁড়া – ১ চা চামচ
- লাল মরিচ গুঁড়া – ২ চা চামচ
- ধনে গুঁড়া – ২ চা চামচ
- জিরা গুঁড়া – ১ চা চামচ
- গরম মশলা গুঁড়া – ১ চা চামচ
- গোল মরিচ গুঁড়া – ½ চা চামচ
- লবণ – স্বাদমতো
- রাধুনি মশলা গুঁড়া – ১ চা চামচ
- সরিষার তেল – ½ কাপ
রান্নার জন্য:
- পেঁয়াজ কুঁচি – ৪টি বড় (ভেজে বেরেস্তা করা)
- গোটা মশলা – এলাচ ৪টি, লবঙ্গ ৪টি, তেজপাতা ২টি, দারুচিনি ২ টুকরো
- কাঁচা মরিচ – ৬–৮টি চেরা
- শুকনা মরিচ – ৪–৫টি
- ঘি – ২ টেবিল চামচ (ঐচ্ছিক)
প্রণালী
মাংস মেরিনেট করা
- মাংস টুকরো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন।
- দই, আদা-রসুন বাটা, পেঁয়াজ বাটা, মশলা গুঁড়া, সরিষার তেল ও লবণ মিশিয়ে মাংস ভালোভাবে মাখিয়ে নিন।
- অন্তত ২ ঘণ্টা (সেরা ফলাফলের জন্য সারা রাত) মেরিনেট করে রাখুন।
পেঁয়াজ ভাজা
- কড়াইতে তেল গরম করে পেঁয়াজ কুঁচি সোনালি বাদামি করে ভেজে অর্ধেক আলাদা করে রাখুন।
মাংস রান্না শুরু করা
- কড়াইতে গোটা মশলা দিয়ে দিন।
- তারপর মেরিনেট করা মাংস দিয়ে দিন।
- মাংস থেকে পানি ছাড়লে ঢেকে দিন এবং মাঝে মাঝে নাড়তে থাকুন।
- ঢেকে দিয়ে হালকা আঁচে ১.৫–২ ঘণ্টা রান্না করুন।
- মাংস যখন হয়ে তেল উপরে ওঠে আসবে তখন বাগার দিন।
বাগার
- কাড়াইতে তেল দিয়ে তাতে শুকনা মরিচ ও পিয়াজ সোনালি করে ভেঁজে মাংসের উপর ঢেলে দিন।
- এখন আরো ১/২ চ চামুচ রাধুনি গুড়া দিন। এতে আসল স্বাদটা বজায় থাকবে।
- কম আঁচে ধীরে ধীরে ভুনা করুন যতক্ষণ না মাংস কালচে হয়ে আসে।
শেষ ধাপ
- মাঝারি সাইজের দুইটা পিয়াজ পাপরির মত করে কেটে দিয়ে আর ২-৩ মিনিট ভেজে নিন।
- সামান্য ঘি ছিটিয়ে দিন।
- ভাজা পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে সাজান।

পরিবেশনের উপায়
- ভাতের সাথে ঐতিহ্যবাহী পরিবেশন।
- খিচুড়ির সাথে বৃষ্টির দিনে দারুণ লাগে।
- পরোটা বা লুচির সাথে রাতের খাবারে।
- পোলাও ও বোরহানির সাথে বিয়ের আয়োজনে।
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার
- ঈদ-উল-আযহা – কুরবানির পর সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ।
- বিয়ে – অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম খাবার।
- পারিবারিক অনুষ্ঠান – সবার জন্য একসাথে রান্না করা যায়।
- রেস্টুরেন্ট – বিশেষ পদ হিসেবে তালিকায় থাকে।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন ১: এটাকে কালা ভুনা কেন বলে?
এর গাঢ় বাদামি-কালো রঙের জন্যই এ নামকরণ।
প্রশ্ন ২: ঝাল কমানো যাবে কি?
হ্যাঁ, কাঁচা ও শুকনা মরিচ কম ব্যবহার করলে কম ঝাল হবে।
প্রশ্ন ৩: মুরগির মাংস দিয়ে বানানো যাবে?
প্রথাগতভাবে গরুর মাংস ব্যবহার হয়, তবে মাটন বা মুরগি দিয়েও করা যায়।
প্রশ্ন ৪: মাংস পুড়ে যাওয়া রোধ কিভাবে করব?
কম আঁচে ধীরে ধীরে রান্না করতে হবে এবং মাঝে মাঝে নাড়তে হবে।
প্রশ্ন ৫: কতদিন সংরক্ষণ করা যাবে?
৩–৪ দিন ফ্রিজে রাখা যায়, আর পরের দিন স্বাদ আরও ভালো হয়।
নিখুঁত কালা ভুনার টিপস
- সামান্য চর্বিযুক্ত মাংস ব্যবহার করলে ভাল হয়।
- ভালো করে ভাজা পেঁয়াজ (বেরেস্তা) ব্যবহার করুন।
- ধীরে ধীরে রান্না করুন, তাড়াহুড়া করলে স্বাদ নষ্ট হবে।
- সরিষার তেল ব্যবহার করুন আসল স্বাদের জন্য।
- অতিরিক্ত পানি দেবেন না, মাংসের নিজস্ব রসেই রান্না হোক।

উপসংহার
কালা ভুনা শুধুই একটি মাংসের রান্না নয়, এটি চট্টগ্রামের মানুষের ঐতিহ্য ও গর্ব। ধীরে ধীরে রান্না করার ফলে এর মশলার গভীর স্বাদ, কালচে রং এবং গাঢ় ঘ্রাণ অন্য যেকোনো পদ থেকে আলাদা করে তুলে।
ভাত, পোলাও বা পরোটা – যেকোনো কিছুর সাথে কালা ভুনা পরিবেশন করলে তা হয়ে ওঠে এক রাজকীয় ভোজ। সত্যিকারের চট্টগ্রামের স্বাদ পেতে চাইলে কালা ভুনা অবশ্যই রান্না করে দেখতে হবে।
Very yummy 😋 post